Saturday 23 July 2016

খুনি

"খুনি"
-শুভ্র নীল
বুঝলে বুঝলে মুকুন্দ, মেয়েরা যতই রাগ-অভিমান করুক একটা গয়নার লোভ দেখালেই সব উড়ে গিয়ে ভালোবাসা উথলে ওঠে একদম- বাড়ি থেকে আনা লুচি আলুর দমের একটা গ্রাস মুখের মধ্যে চালান করতে করতে বললেন হরিহরডাঙ্গা থানার অফিসার-ইন-চার্জ প্রবাল হাজরা।
হ্যাঁ স্যার, একদম ঠিক বলেছেন। এইতো গত সপ্তাহেই আমার সাথে বৌয়ের খুব ঝগড়াঝাঁটি হয়ে কথা বন্ধ। তারপর বুদ্ধি করে একখান ঢাকাই তাঁতের শাড়ী নিয়ে হাজির হলুম, ছেলের জন্য প্যান্ট কিনতে গিয়ে পছন্দ হয়েছিল- ব্যাস, আর যায় কোথায়... ক্রিং ক্রিং ক্রিং... হেড কনস্টেবল মুকুন্দ বিশাইর কথা মাঝেই বেজে উঠলো ফোনটা। এইরকম বর্ষার দিনেও কার দরকার পড়ে থানায়! ফোন তুললো মুকুন্দ- হ্যালো, কে বলছেন?... খুন! বলেন কি? কোথায়? লোকেশন বলুন... আচ্ছা আচ্ছা...
স্যার খুন হয়েছে। তাও যে সে কেউ নয়, শাসক দলের ব্লক যুবনেতা প্রবীর সামন্ত।
-বল কি? কোথায় হয়েছে?
-ফোন যে করেছিল সে বললো, পলাশপুরের খালপাড়ে যে শিবমন্দির আছে, তার পিছনেই বডি পড়ে আছে।
তারক কোথায়? জিপ বার করতে বল।
হরিহরডাঙ্গা থানা থেকে পলাশপুর দশ কিলোমিটার রাস্তা। দু-তিন কিলোমিটার যাওয়ার পর পাকা রাস্তা ছেড়ে মোরামের রাস্তা শুরু হল। মাঠের মাঝখান দিয়ে ফাঁকা সরু রাস্তা, বড় গাড়ি যেতে পারবেনা এ রাস্তায়। বর্ষার কাঁচা মোরামের রাস্তায় গাড়ীর চাকা বসে বসে যায়। গ্রামের দিকের থানাগুলোয় এই এক অসুবিধা যোগাযোগব্যবস্থার, খবর পেলেও ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেরী হয়ে যায় তাই যাইহোক, একটু পরেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ীতে চালক তারকের পাশের সিটে বসেছেন প্রবাল হাজরা, পেছনের সিটে মুকুন্দ বিশাই আর সিভিক ভল্যান্টিয়ার রতন মাইতি। রতন খুব বুদ্ধিমান, বিএসসি পাশ করেও কোনও চাকরীবাকরি না পেয়ে শেষে এটা জোগাড় করেছে অনেক কষ্ট করে। তাকে প্রবাল প্রায়ই সাথে রাখেন। আর রতনের বাড়িও পলাশপুরের পাশের গ্রামেই।
আর কতক্ষণ লাগবে রতন? –সদ্য কয়েকমাস এই থানায় বদলি হয়ে আসা প্রবাল জিজ্ঞেস করেন।
-চলেই এসেছি প্রায় স্যার। আর মিনিট পাঁচেক।
ঘ্যাক্ঘ্যাক্করে একটা আওয়াজ হল হঠাৎ, আর জিপগাড়িটা বিকট জোর শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কি হল তারক?-প্রবালবাবু চমকে জিজ্ঞেস করলেন।
-স্যার, কাদামাটিতে চাকা বসে গেছেঠেলে গাড়ি তুলতে হবে।
জিপগাড়িটার পেছনের বামদিকের চাকাটা বিশ্রীভাবে বসে গেছে কাদায়। বর্ষার মুখে কাঁচা মোরাম দিয়ে রাস্তা করলে যা হয়!-মুকুন্দ বিশাই গজরাতে থাকেন। তারক স্টিয়ারিং ধরে বসলো, বাকি তিনজন ঠেলা লাগিয়েও গাড়ি কাদার মধ্যে থেকে তোলা গেলনা। বাধ্য হয়ে তারক বাদে বাকি তিনজন পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললেন গন্তব্যের দিকে।
খুনের জায়গাটায় বেশ ভিড় জমে গেছে ইতিমধ্যে। ভিড় ঠেলেই এগোতে লাগলো তিনজন। ছোটো পাকার একটা শিবের মন্দির, তার পেছন দিয়ে একটা খাল, মন্দিরের পেছনেই বডিটা পড়ে, পা দুটো প্রায় খালের জলে গিয়ে পড়েছে।
বডিটা কে দেখেছে ফার্স্ট?-চড়া গলায় প্রবালবাবু জিজ্ঞেস করলেন ভিড়ের উদ্দেশ্যে
“আজ্ঞে, আমানে সকালে মাছ লিয়া যাইথিলি বাবু, তখুনি দেখলি এই লোকটা এঠি শুয়া আছে। ভাবলি, কুনো মাতাল হয়ত পড়িয়া আছে, ন্যাশা কাটলে ঠিক ঘর চলিয়াবে। তারপর যখন ঘুরিয়া আইসি তখনো দেখি লোকটা পড়িয়া আছে অ্যারকমভাবে। তখনি আমানে লোকটাকে উল্টি দেখি এ ত প্রবীরবাবু!” লোকটার কথা এখানকার গ্রাম্য ভাষায় হলেও প্রবাল হাজরার বুঝে নিতে অসুবিধা হয়না কথাগুলো। আপনি কে? আপনার সাথে আর কে কে ছিল? “আইজ্ঞে বাবু আমার নাম তপন আমার সাথে...” পুরো নাম কি?-ধমক দেন প্রবালবাবু। “তপন বর্মণ বাবু, আমি মাছের ব্যবসা করি। আইজকেও...” হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে ষণ্ডামার্কা মত একজন এগিয়ে আসে। “আপনাদের কখন খবর দেওয়া হয়েছিল, আর আপনারা এখন এলেন?”-ষণ্ডামার্কা লোকটি বেশ ঝাঁঝিয়ে ওঠে প্রবালবাবুর দিকে তাকিয়ে।
আপনার পরিচয়?-প্রবাল হাজরার এমন প্রশ্ন বোধহয় আশা করেনি লোকটা। থমকে গিয়ে রতনের দিকে কি যেন ইঙ্গিত করে সে। রতন প্রবাল হাজরার দিকে তাকিয়ে বলে- স্যার, ইনি এখানকার পঞ্চায়েত সদস্য, তুষার মাঝি। “শুনুন আমাদের নেতা খুন হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে খুঁজে বার না করতে পারলে আমরা বডি ওঠাতে দেবোনা এখান থেকে।”-চেঁচাতে থাকে তুষার মাঝি।
প্রবাল হাজরা যেন এবার দুঁদে পুলিশ অফিসার হয়ে ওঠেন। ধমক দেন- সরে যান আমাদের এখান থেকে। পুলিশের কাজে বাধা দিলে আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হবো।
ধমকে কাজ দেয় অনেকটা। মুহূর্তের মধ্যে ভিড়টা পাতলা হয়ে সরে যায় তুষার মাঝির সাথে সাথে। বডির কাছে আসেন তিনজন। বডিটার পেটে বেশ গভীর কয়েকটা ক্ষত, উল্টে দেখা গেল পিঠেও হালকা একটা ক্ষত রয়েছে। প্রবাল হাজরা অভিজ্ঞ অফিসার। বলেন, মনে হয় বেশ অনেকক্ষণ আগেই খুনটা হয়েছে, রক্তক্ষরণ অনেক আগে বন্ধ হয়ে রক্ত বেশ শুকনো একটা ভাব এসে গেছেজায়গাটা নির্জন আর বৃষ্টির দিন হওয়ায় কেউ দেখতে পায়নি আগে। স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?-মুকুন্দ বিশাই জিজ্ঞেস করেন প্রবাল হাজরাকে। -হ্যাঁ, বলো মুকুন্দ।
-স্যার, এই প্রবীর সামন্ত বেশ উপরের লেভেলের নেতা শাসকদলের। এখানে উনার কথাই শেষ কথা ছিল, এতটাই প্রভাব উনার। উনাকে কেউ কেন খুন করবে? এত সাহস কার হবে এখানে?
-সেটা এখন বোঝা খুবই শক্ত মুকুন্দ। আপাতত আমাদের বডিটা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবালবাবু রতনকে জিজ্ঞেস করেন, এখানে ভ্যান কোথায় পাওয়া যাবে?
-গ্রামের দিকে মড়া বইতে কেউ ভ্যান দেবেনা স্যার। তবে ওই তুষার মাঝি কে বললে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। শেষের কথাটা সে বললো আস্তে করে।
আচ্ছা মুকুন্দ, তুমি বডিটা একটু ভালো করে সার্চ করে দেখো কিছু পাও কিনা, আর রতন তুমি চারদিকটা একটু খুঁজে দেখো কিছু সূত্র মেলে কিনা- আমি দেখি কিছু ব্যাবস্থা হয় কিনা।মাথার মধ্যে অপমানের রাগটা আবার মাথাচাড়া দিলেও প্রবাল হাজরার সামনে এখন আর কিছু পথও নেই এছাড়া। অগত্যা তিনি এগিয়ে এসে তুষার মাঝির কাছে গেলেন। তুষার মাঝি তখন শিব মন্দিরের একটা খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন
-দেখুন মাঝিবাবু, আমরা খুব তাড়াতাড়িই খুনিকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করবো। কিন্তু তার জন্য বডি নিয়ে যেতে হবে আমাদের। আর সেকাজে আপনার একটু সাহায্য চাই আমাদের।
-বলুন, কি হয়েছে? বেশ গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন তুষার মাঝি।
-আমরা বডিটা নিয়ে যাবো একটা ভ্যান জোগাড় করে দিতে হবে আপনাকে।
-দাঁড়ান, একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুষার মাঝি উঠে গেলেন একটা জটলার দিকে।
হঠাৎ রতন ছুটতে ছুটতে আসে। তার হাতে একটা খালি মদের বোতল আর দুটো প্লাস্টিকের গ্লাস। স্যার দেখুন এগুলো কাল রাতেই সম্ভবত ব্যবহার করা হয়েছে। বডির থেকে একটু দূরে পড়েছিল।
-রতন তুমি ওগুলো খালি হাতে ধরে এনেছো! তোমাকে আমি বুদ্ধিমান বলেই জানি!
-সরি স্যার, ভুল হয়ে গেছে। আসলে তাড়াহুড়োতে পকেট থেকে রুমাল বের করতেই ভুলে গেছি।
-ড্যাম ইট! গজরাতে গজরাতে রুমাল বের করে গ্লাসদুটো হাতে ধরেন প্রবালবাবুএখনও মদের গন্ধ লেগে আছে গ্লাসদুটোতে। বোতলটাতেও কিছুটা মদ রয়ে গেছে!
-এই যে স্যার, আপনার ভ্যান এসে গেছে, হাঁক পাড়েন তুষার মাঝি।
কালো বেঁটে মত একজন ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুকুন্দ এসে বললেন, স্যার কিছুই পেলামনা বডিতে! –ঠিক আছে, বডিটাকে ভ্যানে তোলাও মুকুন্দ। প্রবালবাবু এগিয়ে যান তুষার মাঝির দিকে। আর একটা ছোট্ট সাহায্য লাগবে মাঝিবাবু
-হ্যাঁ, বলুন
-আমাদের জিপটা কাদায় আটকে গেছে খানিক দূরে, একটু তুলে দেওয়ার মত ব্যবস্থা করতে হবে
-আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বসুন মন্দিরে, আমি ব্যবস্থা করছি
কয়েকজনকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন, তারপর এগিয়ে এলেন প্রবালবাবুর দিকে আচ্ছা স্যার কি মনে হয় আপনার?
-সেটা এখনই কিছু বলা সম্ভব নয় মাঝিবাবু দেখা যাক আপনি বরং প্রবীরবাবুর বাড়ির কাউকে থানায় নিয়ে আসবেন আর আপাতত আমাদের তেমন কিছু কাজ নেই এখানে আপনারা কিছু জানতে পারলে আমাদের জানাবেন কথার মাঝখানেই মুকুন্দ চেঁচিয়ে বললো, স্যার বডি ভ্যানে তোলা হয়ে গেছে প্রবালবাবু নিজে গিয়ে দেখে নিলেন, বডি ঠিকঠাক বাঁধা হয়েছে কিনা ভ্যানওয়ালাকে বললেন, চলো
তুষার মাঝি সাথে সাথে চলেছেন কিছুদুর গিয়ে যেখানে গাড়ির চাকা বসে গেছিল, সেখানে দেখা গেল, পাঁচজন লোক প্রাণপণে জিপটাকে ঠেলে চলেছে আর চালক তারক অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিয়েই চলেছে কিন্তু প্রচণ্ড আওয়াজ আর কালো ধোঁয়া বেরানো ছাড়া আর কিছুই হচ্ছেনা
হঠাৎ মুকুন্দ বিশাই বলে উঠলেন, স্যার এই জায়গাটা দেখুন, কেমন যেন কাদামাটি মত, কিন্তু গোটা রাস্তাই তো মোরামের... অভিজ্ঞ পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রবাল হাজরার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। তিনি রাস্তার যেখানে গাড়ির চাকা বসেছে সেদিকটায় নেমে গেলেন। বেশ খানিকটা নিচ পর্যন্ত একইরকম মাটি। শেষে গিয়ে যেন মনে হল, জায়গাটা কেউ আগে খোঁড়াখুঁড়ি করে আবার মাটিচাপা দিয়েছে।
-মাঝিবাবু মনে হয়, আপনার আর একটু সাহায্য লাগবে। গাড়ির চাকাটা মাটি কেটে তুলতে হবে মনে হয়। একটুক্ষণের মধ্যেই একজন দুটো কোদাল আর একটা শাবল নিয়ে হাজির হল। শুরু হল মাটি কাটা। খানিকক্ষণ পর গাড়ি তোলা গেল কাদা থেকে। গাড়ির চাকা সরতেই প্রবাল হাজরার চোখ যেন চকচক করে উঠলো, যেন তিনি গুপ্তধন পেয়েছেন। সেটা খেয়াল করলেন একমাত্র মুকুন্দ বিশাই।
-কি হল স্যার?
-ওই দেখো মুকুন্দ, মনে হয় এখানে কিছু সূত্র উঁকি মারছে। মুকুন্দ দেখলেন একটা কালো প্লাস্টিক বেরিয়ে এসেছে একটু। লোকগুলোকে দিয়ে পুরো মাটি কাটতে লাগানো হল। আলগা মাটি সরতে লাগলো তাড়াতাড়ি। তুষার মাঝি সহ সবাই ভিড় করে আছে যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে সেই জায়গাটার চারপাশে। খানিক বাদেই পুরো একটা কালো ত্রিপলে মোড়া লাশ বেরিয়ে এল, একটা কুড়ি-একুশ বছর বয়সী একটি মেয়ের লাশ। অনেকটা পচা গলা হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় কোনও কলেজে পড়তো। তুষার মাঝি আঁতকে উঠলেন, “আরে এতো আমাদের মাস্টারমশাই হরিবাবুর মেয়ে কামিনী!” প্রবাল হাজরা হুকুম দিলেন, এই বডিটাকেও ভ্যানে তুলে নিতে -তুষারবাবু আপনি মাস্টারমশাইকে নিয়ে থানায় আসবেন একবার।
দুদিন বাদে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এল সদর থেকে। প্রবীর সামন্তর পায়ের গোড়ালিতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। সম্ভবত দৌড়ে পালাতে চাইছিলেন তিনি, তখনই পেছন থেকে পায়ে আঘাত করা হয়। তারপর পেছন থেকে পেটে ছুরি বা ওই জাতীয় কিছু অস্ত্র দিয়ে পাঁচবার আঘাত করে আততায়ী। আর সবচেয়ে বড় চমকপ্রদ যে তথ্যটা পাওয়া গেল, সেটা হল যেদিন প্রবীর সামন্তর বডি যেদিন পাওয়া যায়, খুনটা হয় তার আগেরদিন রাতে। আর কামিনীকে গলার ওড়নার প্যাঁচ দিয়ে মারা হয় একসপ্তাহ আগে, তার সারা শরীরে আঁচড়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে, খুন করার আগে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছিল সম্ভবত। সেদিন বিকেলেই তুষার মাঝি থানায় এলেন সাথে পার্টীর অনেক লোকজন। প্রবীর সামন্তের বাড়ির লোক কেউ আসেনি। কয়েকজন বড় মাপের নেতা এসে কথা বলে গেলেন প্রবালবাবুর সাথে, প্রবালবাবু তাদের আশ্বাস দিলেন খুনিকে খুঁজে বের করবেনই। তারা সব বডি নিয়ে চলে গেল।
পরেরদিন সকালে তুষার মাঝির সাথে এলেন এক বুড়োমত ভদ্রলোক“স্যার, ইনি আমাদের গ্রামের মাস্টারমশাই হরিপদবাবু।”
-বসুন হরিপদবাবু, আপনার মেয়ে খুন হয়েছেন একসপ্তাহ আগে। এতদিন ধরে নিখোঁজ, পুলিশকে জানাননি কেন? প্রবালবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
-আসলে মেয়ে অনেকসময় পড়াশোনার জন্য বান্ধবীদের কাছে থেকে যেত, তাই অতটা ভাবনা আসেনি।
-একসপ্তাহ ধরে মেয়ে বাড়িতে আসতোনা, কিছু না জানিয়েই!
-না, ঠিক তা নয়। তবে দু-তিনদিন আসতোনা অনেকসময়।
-দু তিন দিনের জায়গায় এক সপ্তাহ একটা মেয়ে বাড়ি আসেনি আপনি কোথাও খোঁজও নেননি, আর পুলিশকেও জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি?
এবার যেন একটু ঝাঁঝিয়ে জবাব দিলেন হরিবাবু, “বেশ করেছি, আমার মেয়ে, আমি দরকার মনে করিনি পুলিশকে জানানোর, তাই জানাইনি কিছু। এতে সমস্যা কোথায়?”
প্রবালবাবুর কপাল কুঁচকে উঠল এবার। পাশ থেকে তুষার মাঝি বললেন, “স্যার, মাস্টারমশাই খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ, এসব পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চান না। তাই হয়ত...”
“আমি আমার মেয়ের বডিটা নিয়ে যেতে এসেছি।”
প্রবালবাবু ডাক দিলেন, মুকুন্দ?
মুকুন্দ বিশাই আসতে তাকে বলে দিলেন “এনাকে কামিনীর বডি দিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এলেন মুকুন্দ বিশাই। “স্যার, তুষার মাঝি আপনাকে কিছু বলতে চান।”
-আচ্ছা, পাঠিয়ে দাও উনাকে।
দরজা ঠেলে ঢুকলেন তুষার মাঝি। অনুমতির তোয়াক্কা না করেই একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতেই বললেন, “স্যার, প্রবীরবাবুর খুব কাছের ছিল কালু। তাকে আমরা বেশ কয়েকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছিনা।”
-মানে? উনার বাড়ি কোথায়? কি করেন উনি?
-বাড়ি তো স্যার আমাদের পাশের গ্রাম গোকুলপুরে। সবসময় প্রবীরদার সাথেই দেখতাম তাকে। প্রবীরদা খুন হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তাকে আর দেখা যায়নি। বাড়িতেও নেই সে। আমাদের ওখানকার লোকেরা জানিয়েছে যে ওকে দেখা যায়নি বেশ কয়েকদিন ধরেই।
-আচ্ছা প্রবীরবাবুর কি কোনও শত্রু ছিল যে উনাকে খুন করতে পারে?
-না স্যার, উনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমি যতটা জানি দলের মধ্যেও কেউ ওনার বিরুদ্ধে ছিলনা। এইতো আপনাদের রতনকেও উনি এই কাজটা পেতে সাহায্য করেছেন। আচ্ছা স্যার, আজ চলি। উঠে দাঁড়ালেন তুষার মাঝি।
তুষার মাঝি বেরিয়ে যাওয়ার পর রতনকে ডাক দিলেন প্রবালবাবু, রতন?
দরজা ঠেলে রতন ভেতরে এল, হ্যাঁ স্যার বলুন।
-তুমি প্রবীর সামন্তকে চিনতে?
-হ্যাঁ স্যার একটু আধটু জানতাম।
-প্রবীর সামন্ত তোমাকে সাহায্য করেননি এই কাজটা জোটাতে?
একটু যেন থমকে রতন জবাব দিল, “হ্যাঁ তা উনি করেছিলেন বটে কিন্তু সেইটুকুই যা।”
-কোনও শত্রু ছিল ওনার? তুমি তো ওখানেই পাশের গ্রামে থাকো।
-না স্যার, আমার ঠিক জানা নেই
-আচ্ছা যাও কাজ কর।
তবুও রতন যেন কিছু বলবে বলে দাঁড়িয়ে রইল।
-কি হল কিছু বলবে রতন?
-স্যার, আমার আজ দুপুর থেকে কাল রাত পর্যন্ত ছুটি চাই।
-কেন? কি জন্য?
-আমার মায়ের শরীরটা ভালো নয়, মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো স্যার।
-সেতো একদিনের ব্যাপার। কালই নাহয় ছুটি নিও।
রতন চলে গেল মুখ নিচু করে।
পরেরদিন সকালে পলাশপুরের খালপাড় থেকে উদ্ধার হওয়া গ্লাসদুটো আর মদের বোতলটার ফরেন্সিক রিপোর্ট এল। গ্লাসদুটোর একটায় শুধু প্রবীর সামন্তর আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে একটু অংশে, বাকি ছাপটা রতনেরই। অন্য গ্লাস আর বোতলটাতেও রতনেরই আঙুলের ছাপ। রতনকে আগে কখনও গাধা ভাবেননি প্রবাল হাজরা। দুদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ার পরেও একটু জায়গায় প্রবীর সামন্তর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে মানে রতন যদি খালিহাতে ওগুলো না ধরতো, তবে নিশ্চয়ই আর কারুর ছাপ পাওয়া গেলেও যেতে পারতো। পুরো কেসটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। খুনের উদ্দেশ্যটাই বোঝা যাচ্ছেনা, তাতেই হয়তো খুনিকে খুঁজে পাওয়া যেত। কি মনে করে উঠে পড়লেন প্রবাল হাজরা, হাঁক পাড়লেন, মুকুন্দ? মুকুন্দ বিশাই হন্তদন্থয়ে হাজির হতেই বললেন চলো একটু বেড়িয়ে আসি। আজ বাইক নিয়ে যাবো, কাউকে কিছু জানানোর দরকার নেই। বাইরে বেরিয়ে মুকুন্দ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন স্যার?
-পলাশপুরের মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি। একবার কামিনীর ব্যাপারে কথা বলতে হবে মাস্টারমশাইর সাথে।
সারা রাস্তা আর কোনও কথা নেই, মুকুন্দ কয়েকবার মোটরবাইকের লুকিং গ্লাসে দেখলো স্যার যেন গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছেন। হরিপদবাবুর বাড়িতে পৌঁছে চমকে উঠলেন দুজনেই। রতন! তুমি এখানে? –মুকুন্দ বিশাই চেঁচিয়ে উঠলেন।
-মাস্টারমশাইর শরীরটা খারাপ, তাই একটু এলাম দেখা করতে। স্যার, আপনারা হঠাৎ এখানে?
-এমনি হরিপদবাবুর সাথে কিছু কথা বলতে এলাম। যদি কিছু জানা যায়- কিন্তু, তোমার তো তোমার মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ছিল?
-আসলে স্যার, মা আজ অনেকটাই সূস্থ, তাই আর যাইনি।
-ঠিক আছে, হরিপদবাবু কোথায়?
-উনি অসুস্থ খুব, তাই ভেতরের ঘরে শুয়ে আছেন।
-ঠিক আছে, একটু কামিনীর জিনিসপত্রগুলো দেখতে চাই। মুকুন্দ একটু উনাকে জিজ্ঞেস করে আসো তো।
মুকুন্দ বিশাইকে নিয়ে রতন গেল ভেতরে। প্রবালবাবু ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রগুলো দেখতে লাগলেন। একটা কাঠের টেবিলের উপর একটা অ্যালবাম রাখা আধখোলা অবস্থায়। আগের পাতাটা উল্টেই প্রবালবাবু যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন- রতন আর কামিনী পাশাপাশি, রতনের বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে কামিনী। ছবিটা বোধহয় দীঘায় তোলা, পেছনে সমুদ্র। তার মানে রতন আর কামিনী একে অপরকে ভালোবাসতো! তবে রতন এতসময় ধরে কেন চেপে রেখেছিল একথা? ভাবতে ভাবতেই রতন এসে পড়লো। প্রবালবাবুর হাতে অ্যালবামটা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উত্তর দিল, হ্যাঁ স্যার আমি আর কামিনী একে অপরকে ভালবাসতাম, আমরা বিয়ে করতাম, আর মাস্টারমশাইও মেনে নিয়েছিলেন। শুধু মাস্টারমশাই চেয়েছিলেন যে কামিনী গ্রাজুয়েশানটা কমপ্লিট করার পরেই আমরা বিয়ে করি। কিন্তু তার আগেই...... একটু ভেঙে পড়েও নিজেকে সামলে নিল রতন। কাল আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম স্যার। মায়ের অসুখের জন্য নয়, কামিনীর শেষ কাজ করার জন্যই আমি ছুটি নিয়েছি। প্রবালবাবু হাত রাখলেন রতনের কাঁধে। ঠিক আছে রতন, আজ থাক, তুমি কাল থানায় এসো, তখন সব শুনবো। আশা করি তোমার থেকে অনেককিছুই সাহায্য হবে এই কেসের ব্যাপারে। আজ চলি। কৈ হে মুকুন্দ চলো যাওয়া যাক আজ। শিবমন্দিরের কাছে এসেই দেখা তুষার মাঝির সাথে। আরে স্যার, এদিকে কোথায়? কি ব্যাপারে? কিছু পেলেন?
-না মাঝিবাবু, কেসটা বড্ড গুলিয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কালুর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল?
-না স্যার, কালুর কোনও পাত্তা নেই। তবে স্যার, কালু প্রবীর সামন্তকে খুন করবেনা কখনওই- আমাদের দলের সব ছেলেরাই এটা বলছে।
-এই কেসে কালুর কিছু না কিছু সম্পর্ক তো আছেই। নাহলে হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে কেন? আচ্ছা মুকুন্দ আগেরদিন পুরো জায়গাটা দেখেছিলে ঠিক করে?
-হ্যাঁ স্যার, আমি আর রতন মিলে তো দেখলাম, তাও আপনি চাইলে একবার দেখবেন চলুন।
কি মনে করে প্রবাল হাজরা চলে গেলেন মন্দিরের পেছনে যেখানে প্রবীর সামন্তর লাশ পড়েছিল। পেছনে পেছন মুকুন্দ বিশাইও। না, তেমন কিছুই চোখে পড়লোনা। উপরে উঠে আসতে গিয়ে প্রবালবাবু হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন, কাদার মাঝখান দিয়ে একটা বেতের লাঠি উঁকি মারছে এক জায়গায়। সেটা হাতে তুলে নিলেন তিনি। তারপর মুকুন্দ বিশাইকে বললেন চলো। তুষার মাঝি কি যেন বলতে এলেন, প্রবালবাবু শুনলেন না। নিজেই চালাতে শুরু করলেন মোটরবাইক। কিছুদুর এসে যেখানে আগেরদিন গাড়ির চাকা বসে গেছিল সেখানে থামলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাটির দিকে চেয়ে কি যেন ভাবতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কাছে মোবাইল আছে মুকুন্দ?
-হ্যাঁ স্যার আছে।
-এক্ষুনি থানায় ফোন করে জিপে করে তিনজন কনস্টেবল আনাও।
আধঘণ্টার মধ্যে তিনজন কনস্টেবল এসে গেল জিপগাড়িতে করে। প্রবালবাবু বাইক নিলেন। মুকুন্দ বিশাইকে বললেন জিপে উঠে তাঁকে অনুসরণ করতে। প্রবালবাবু বাইকে আর বাকিরা জিপে করে এসে থাম্লেন আবার মাস্টারমশাই হরিপদবাবুর বাড়ির সামনে। দরজায় আওয়াজ করতে রতন দরজা খুলতে এসেই এতজন একসাথে দেখে দারুণভাবে থমকে গেল। প্রবাল হাজরা তাঁকে ঠেলেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন। দুটো ব্যাগ গুছিয়ে রাখা টেবিলের উপর, হরিপদবাবুও দাঁড়িয়ে আছেন।
-তারপর রতন, দুজনকে খুন করে কোথায় পালানোর মতলব করেছো?
-মানে কি বলছেন স্যার? আমি কাকে খুন করবো? কামিনী আর নেই। তাই আমি মাস্টারমশাইকে নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছি, এখানে আর পড়ে থাকতে চাইনা।
-তা যাওয়ার আগে তোমার সরকারী লাঠিটা ফিরিয়ে দিয়ে যাবেনা যেটা প্রবীর সামন্তকে ছুঁড়ে মেরেছিলে পেছন থেকে? বলেই কুড়িয়ে পাওয়া লাঠিটা ঠক করে ফেললেন মেঝের উপরে। রতন এবার হকচকিয়ে গেল বেশ, তারপর দরজার দিকে দৌড়ে জেতেই দুজন কনস্টেবল তাঁকে জাপটে ধরে ফেললো। প্রবালবাবু ঠাস করে এক চড় লাগালেন রতনের গালে, তারপর একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন তাকে। রতন এবার সত্যিই ভেঙে পড়লো।
-হ্যাঁ স্যার, ওই জানোয়ারটাকে আমিই মেরেছি, ওর উচিত শিক্ষা দিয়েছি ওকে। বিএসসি পাশ করেও কোনও চাকরী পাইনি আমি। শেষে প্রবীর সামন্তকে ধরি এই চাকরী টার জন্য। কিন্তু লোকটা আমাকে এটা করে দেওয়ার বদলে পাঁচ লাখ টাকা চায়। আমি এই শর্তে রাজি হই যে চাকরী পাওয়ার পর প্রতি মাসে বেতনের থেকে হাফ করে দিয়ে পুরো টাকাটা মেটাবো। ওই শয়তানটাও রাজি হয়েছিল এতে। কিন্তু হঠাৎই ও একদিন কামিনীকে দেখে আর জানতে পারে যে আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। ও আমাকে বলে আমি কামিনীকে ছেড়ে দেই যেন, যাতে ও কামিনীকে বিয়ে করবে, তাহলেই ও আমার থেকে আর এক টাকাও নেবেনা। নাহলে আমার চাকরী চলে যাবে। আমি মাস্টারমশাইকে জানাই সব। সেদিন কামিনী কলেজ থেকে ফিরছিল, একটু সন্ধ্যে সন্ধ্যে হয়ে এসেছিল, ওই শয়তান প্রবীর সামন্ত কামিনীকে জোর করে... বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ওঠে রতন, তারপর আবার নিজেকে সামলে বলতে থাকে- কুত্তাটা অনেক জায়গাতেই অনেক কুকীর্তি করে বেড়াতো আমি টাকার জন্য ওকে কিছু বলতে পারিনি। সেদিন সন্ধ্যায় থানা থেকে ফিরে কালুর সাথে আমার দেখা হয়। কালুর সাথে আমার মোটামুটি ভালোই সম্পর্ক ছিল। দুজনে মিলে মদ খেতে বসি। নেশার ঘোরে কালু বলে দেয় সব। আমার আর মাথার ঠিক থাকেনি। আমি কালুকে দিয়ে প্রবীর সামন্তকে বলে পাঠাই যে আমি তাকে দশ হাজার টাকা দেবো, সে যেন পরের দিন সন্ধ্যায় শিব মন্দিরের সামনে আসে। পরেরদিন থানা থেকে এসে আমি মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করি। সেদিন প্রবীর সামন্ত একাই আসে। সেখানে আমরা মদ খাবো বলে বসি। একটুক্ষণ পরেই প্রবীরের নেশা হয়ে যায়, ওকে প্রথম থেকে বুঝতেও দেইনি যে আমি কি চাই, ও ভেবেছিল আমি ওকে খাতির করছি। কিন্তু খানিক বাদেই আমার হাতে ছুরি দেখে ও ঘোরের মধ্যেও পালাবার চেষ্টা করে। আমি লাঠিটা ছুঁড়ে মারি ওকে তারপর কিভাবে ওকে মেরেছি আপনি জানেন স্যার।
-হুম তারপর ওই লাঠিটার কথা ভুলে যাও... কিন্তু কালু কোথায়?
-কালু সবসময় প্রবীরের সাথে সাথে থাকতো, সেদিনও আসে একটু দেরিতে আর আমাকে দেখে ফেলে। আমি কালুকে বোঝাই যে লোকটা মারা যাওয়ায় আমাদের সুবিধাই হবে। প্রবীরের বেনামে অনেক মাছের ভেড়ি চলে, কালু সেসবের দেখাশোনা করতো। আমি ওকে বোঝাই যে এবার থেকে ও সেসবের মালিক হতে পারবে। কালু খানিকক্ষণের জন্য আমাকে সাহায্য করে লাশটাকে মন্দিরের পেছনে টেনে এনে একটা আলগা বস্তা চাপা দিয়ে দিতে, কিন্তু তারপর হঠাৎই ও আবার বলে পুলিশের কাছে সব জানানো উচিত। বাধ্য হয়ে আমি ভান করি যে আমি পুলিশের কাছে সব বলবো, তারপর সুযোগ বুঝে কালুর গলাতেও ছুরি চালিয়ে দেই। কালুর লাশটাকে নিয়ে আমার মাথায় আইডিয়া আসে, যে যদি কালু চিরকালের মত হারিয়ে যায় তাহলে লোকে ভাববে যে কালুই প্রবীর সামন্তকে খুন করে পালিয়েছে। তারপর কালুর লাশের সাথে মন্দিরের পেছনে পড়ে থাকা একটা বড় পাথর বেঁধে খালের জলে ডুবিয়ে দিয়েছি।
-হুম আমার প্রথমেই মাস্টারমশাইর উপর সন্দেহ হয়েছিল, যে উনি কিছু লুকোচ্ছেন। নাহলে নিজের মেয়ে এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ থাকলেও কেউ এতটা ভাবলেশহীন কি করে থাকতে পারে! তারপরে সন্দেহ আসে রতনের মিথ্যেগুলোর উপরে। সেদিন যে ও ইচ্ছে করেই হাত দিয়ে গ্লাসদুটো ধরেছিল সেটা আজই প্রথম মাথায় আসে লাঠিটা পাওয়ার পর। সেখান থেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে যায়। অবশ্য তুষার মাঝিও বেশ ভালো সাপোর্ট করেছেন তদন্তে  তা রতন, সম্ভবত ভুলে গেছিল লাঠিটার কথা, তাই ওখান থেকে সরাতে পারেনি। তাই না রতন?
-না স্যার। আমি সেদিন সরাতে পারিনি সকাল হয়ে এসেছিল বলে। তারপর আপনার সাথে বডি উদ্ধার করতে এসে মুকুন্দবাবুর কড়া নজরের সামনে কিছু চাপা দেওয়া সম্ভব ছিলোনা। আর সেদিন কামিনীর বডিটা ওভাবে দেখার পর আমি সত্যিই খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তাই আর মনে আসেনি লাঠির কথা।
-বুঝলাম, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে খুব বড় অপরাধ করেছো। আর মাস্টারমশাই, আপনি সবকিছু জেনেও একজন খুনিকে সাপোর্ট দিচ্ছিলেন? হঠাৎ টলতে লাগলেন, প্রবালবাবু তাঁকে ধরে ফেললেন। রতন এবার কেঁদে ফেললো, -স্যার এই বুড়ো মানুষটাকে ছেড়ে দিন, উনি কোনও অন্যায় করেননি। আমিই এনাকে নিয়ে এখান থেকে চলে যেতে চেয়েছিলাম, কারণ আমি বুঝে গেছিলাম আপনি ঠিক সত্যিটা বের করে ফেলবেনই।
পরেরদিন সকালে হরিহরডাঙ্গা থানায় নিজের ঘরে বসে আছেন প্রবাল হাজরা, সামনেই মুকুন্দ বিশাই। রতন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে।
-স্যার আপনি আমাকে মুক্তি দিলেন কেন? রতন জিজ্ঞেস করলো।
-তুমি মেধাবী, তোমার মধ্যে যোগ্যতা আছে অনেক ভালো কিছু করার। তোমাকে আমি ভরসা করি রতন। আশা করি তুমি আমার ভরসার দাম দেবে।
কিন্তু স্যার উপরতলা থেকে কিছু জানতে চাইলে কি বলবেন?-মুকুন্দ বিশাই জিজ্ঞেস করলেন।
-কেন মুকুন্দ? রতন তো সব সাজিয়েই রেখেছে। কালু খুন করে পালিয়েছে প্রবীর সামন্তকে। একটা ব্যাপার কি জানো মুকুন্দ, তোমার আমার চোখে, আইনের চোখে রতন খুনি, অপরাধী। কিন্তু আমাদের সিস্টেম একজন প্রতিভাকে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ারের সংস্থান দিতে পারেনা, তার থেকে কেড়ে নেয় সবকিছু... আমাদের সমাজ, যার কাছে রতন অপরাধী সে কি রতনের খুনি নয়?
মুকুন্দ বিশাই চুপ করে মাথা নিচু করে রইলেন, রতনের দুচোখ বেয়ে জল নেমে এল, সে একটা প্রণাম করলো প্রবালস্যারকে।

মনের কথা-Moner Katha